১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ সভায় ৫ অক্টোবর দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর প্রথম পালিত হয় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। তারপর থেকেই প্রতি বছরের ৫ অক্টোবর এ দিবসটি উদযাপিত হয়। এ বছরেও সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১০০ দেশে ৪০১টি শিক্ষক সংগঠন দিবসটি উদযাপন করছে। উল্লেখ করা যায় যে, ইউনেস্কো সপ্তাহব্যাপী এর আয়োজন করে থাকে। প্রতি দুই বছর পর পর শিক্ষকতায় শিক্ষন-শিখন মানোন্নয়নে শিক্ষকদের কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতার জন্য ‘ইউনেস্কো- হামদান’ পুরস্কার দিয়ে থাকে।
এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়–‘শিক্ষক: সংকটে নেতৃত্বে, ভবিষ্যতের পুনর্নির্মাণে’ করোনার এই সময় শিক্ষার যে সংকট তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলায় শিক্ষকদের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পুনর্নির্মাণে শিক্ষকদের ভূমিকা কি হবে তাই এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় উঠে এসেছে। শিক্ষার ভবিষ্যৎ কি হবে, কেমন হবে, কীভাবে সাজানো হবে শিক্ষার ভবিষ্যৎ এবং এই সাজানোর মধ্যে শিক্ষকের ভূমিকা কি হবে সেটাও ভাবতে হচ্ছে।
আগামীতে শিক্ষার ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে শিক্ষকদের যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করা হলো প্রথমেই।
১। শতভাগ শিক্ষিত করার চ্যালেঞ্জ: টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রায় উল্লেখ আছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। কিন্ত করোনার ফলেই সারা বিশ্ব ৪ কোটি শিক্ষার্থী প্রাক-প্রাথমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রায় ২৫ কোটি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় বিদ্যালয়ে আনতে শিক্ষকদের এই সংকট মোকাবেলায় পুনঃপরিকল্পনা করতে হবে।
২। পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন: করোনার কারণেই আমাদের ভাবতে হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন নিয়ে। সারা বিশ্বেই পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করার কথা ভাবা হচ্ছে। আমাদের দেশের পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কথাও ভাবা হচ্ছে। সেই নতুন পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রমের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে হবে শিক্ষকদের। পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রম পুনর্নির্মাণে শিক্ষকদের কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে।
৩।শিক্ষার নতুন পরিবেশ তৈরি: করোনার আগের পরিবেশ এবং করোনাকালীন শিক্ষার পরিবেশ আলাদা। শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিতে এসেছে বেশ পরিবর্তন। সম্পূর্ণভাবে আগের পরিবেশে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই এই সময়ে নতুন করে শিক্ষন-শিখন পদ্ধতি ও শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হচ্ছে। সেই পরিবেশের সাথেও শিক্ষকদের খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে।
৪।প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ: সময়ের সাথে নানা প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে হচ্ছে শিক্ষকদের। বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হচ্ছে নিত্যদিনই। দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে প্রযুক্তিও। যেমন করোনার আগে হয়তো অনেক শিক্ষক জানতেন না গুগল মিট, জুম, হোয়াটসআপ দিয়েও শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। কিন্তু করোনার সময় শিক্ষকদের শিখতে হয়েছে অনলাইন টুলস ব্যবহার করে শিক্ষণ-শিখন নতুন পদ্ধতিগুলো। আবার শিক্ষকগণ নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে হয়তো এখনো প্রযুক্তির সাথে তাল মিলাতে পারছেন না। তাই শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। রেডিও, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষকদের সম্যক ধারণা দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
৪। একুশ শতকের শিক্ষক: একুশ শতকের দক্ষতাগুলো যেমন-যোগাযোগ ও দলগত কাজের দক্ষতা, সমস্যা সমাধান ও চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী দক্ষতা, সামাজিক ও নৈতিক দক্ষতা এবং অভিযোজনমূলক দক্ষতাগুলোর অর্জন কৌশল ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দিয়ে পাঠ্যবইয়ের পাঠ উদ্দেশ্যের সাথে সাথে এই দক্ষতাগুলো অর্জন করিয়ে নিতে হবে।
৫। শিক্ষক প্রশিক্ষণ: গতানুগতিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষাবিজ্ঞান, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষন-শিখন কৌশলগুলোতে যে পরিবর্তন এসেছে এবং আধুনিকতার ছাপ লেগেছে তার সাথে শিক্ষকদের যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন কত সহজভাবে করা যায় তা জানতে হলে সেই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দেশ ও বিদেশের অফলাইন ও অনলাইন প্রশিক্ষণগুলোতে অংশগ্রহণ নিয়ে সংকটের এই সময়ে নেতৃত্ব দিতে হবে সামনে থেকেই।
৬। দূরবীক্ষণ শিক্ষণ-শিখন: করোনার কারণে বর্তমান শিক্ষার প্রায় অধিকাংশই চলছে দূরবীক্ষন পদ্ধতির মাধ্যমে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনেকেই জুমে, গুগল মিটে নিচ্ছেন ক্লাস। কেউ কেউ রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমেও ক্লাস পরিচালনা করছে। সরাসরি শ্রেণি কার্যক্রম এবং দূরবীক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রমে পার্থক্য আছে। দূরবীক্ষণ শিক্ষার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষন-শিখন কার্যক্রম। ফলে দূরবীক্ষণ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে সামনে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি কার্যকরী করার বিষয়টি নিয়েই ভাবতে হবে।
৭।পুনরায় বিদ্যালয় খোলা: শিক্ষকদের জন্য সামনে যে বিষয়টি খুবই চ্যালেঞ্জিং তা হলো বিদ্যালয় খোলা নিয়ে ভাবতে হবে। নিজ নিজ দক্ষতা, পরিকল্পনা নিয়ে বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এবার আসি ইউনেস্কো যে থিম নিয়ে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২০’ পালন করতে যাচ্ছে তা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষকদের নেতৃত্ব বিকাশে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা নিয়ে।
শিক্ষক নেতৃত্ব: ভবিষ্যতের পুনর্নির্মাণে শিক্ষকদের ক্ষতায়ন, কার্যকারিতা ও কার্যক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনাকালীন সময়টাতে শিক্ষা সংকট মোকাবেলায় শিক্ষকদের নেতৃত্ব গুণাবলি থাকা খুবই জরুরি। তাই শিক্ষকদের নেতৃত্ব বিকাশের কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১। শ্রেণিকক্ষে নেতৃত্ব: বর্তমানে শিক্ষকের ভূমিকা ভাবতে হচ্ছে দুইভাবে। একটি হলো সরাসরি শ্রেণিকক্ষে এবং অপরটি হলো ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষে। শ্রেণিকক্ষের নেতৃত্ব হলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মেধা, যোগ্যতা ও ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষণ-শিখনের পদ্ধতি, শিক্ষাক্রম, শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা, ধারাবাহিক শিখন, শিখনের মূল্যায়ন, বিভিন্ন বিষয়ের শিখন উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কোনো কিছুর ভূমিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকের অবদান সামান্য থাকলেও কার্যকরী ও উদ্ভাবনীয় শিক্ষণ-শিখনে শিক্ষক নেতৃত্ব দিবেন। শিক্ষণে প্রযুক্তি ব্যবহার, পরিচালনা-কৌশল, অনলাইন শিখন পরিচালন মাধ্যম যেমন রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ব্যবহার সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য হতে হবে। তাছাড়া শিখন উদ্দেশ্য, শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি যা দূরবীক্ষণে কীভাবে কার্যকরী করা যায় সেই সিদ্ধান্ত ও শিক্ষকদেরই নিতে হবে।
২. বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব: একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা করার জন্য নানা কাজ শিক্ষকতার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পালন করতে হয়। দূরবীক্ষণ শিক্ষণ- শিখনে বিদ্যালয়ের নিজস্ব পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করতে, শিখন পদ্ধতি ও মাধ্যম নির্বাচন করতে, কোন সফটওয়্যার বিদ্যালয়ের জন্য উপযোগী সেটা নির্বাচন করতে শিক্ষকগণকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাছাড়া অনলাইনে বিদ্যালয় পরিচালনায় শ্রেণির সময়, পদ্ধতি এবং শিখন উপকরণ নির্বাচনেও প্রধান শিক্ষকের পাশাপাশি সকল শিক্ষক সমানভাবে ভূমিকা রাখবে। যে সকল অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়েছেন তাদের দিয়ে একটি দল তৈরি করে দিতে হবে যেন অন্য যেসকল শিক্ষক এই দূরবীক্ষণ শিক্ষণের সাথে খাপ খাইয়ে উঠতে পারছে না তাদের সহযোগিতা করতে পারে। শিক্ষকগণ প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। একটি বিদ্যালয়কে অনলাইনে আনার এই প্রচেষ্টায় সবাইকে সমানভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।
৩. সামাজিক নেতৃত্ব: অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের পাশাপাশি নিজেদের শিক্ষাক্রম উপাদান যেমন শিখন উদ্দেশ্য, বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যসূচি, শিক্ষণ পদ্ধতি, পাঠ্যবই ও মূল্যায়ন পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয় করার পাশাপাশি অন্যান্য বিদ্যালয়ের সাথে একটা সমন্বয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব শিক্ষকদের নিতে হবে। শিক্ষাক্রমের ধারণা পুনঃপরিকল্পনা করার জন্য সমাজের সাথে শিক্ষাবিদদের যোগাযোগ করতে হবে। সমাজের এবং অন্যান্য শিক্ষক সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ রেখে এগিয়ে যেতে হবে। যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একতা, ঐক্যতা আনতে হবে। সবার সিদ্ধান্ত এক হলে সামাজিক যেকোনো সমস্যা প্রশমন করা সম্ভব হয়। একটি বিভাগে অনেক বিদ্যালয়ই থাকে। সব বিদ্যালয় একসাথে যেকোনো সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিয়ে সামনে আগালে যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে সহজ হয়।
সবশেষে বলতে হয় বর্তমান সময়ে শিক্ষকগণ নিজ নিজ দক্ষতা ও যোগ্যতা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে সঠিক দিক-নির্দেশনা স্থির করে যদি এগিয়ে যায় তাহলে করোনার সময়ে শিক্ষা সংকট কেটে গিয়ে ভবিষ্যতের পুনর্নির্মাণের অন্যতম সময়ের সম্মুখীন যোদ্ধা হবেন শিক্ষকরাই। শিক্ষকদের আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদানে আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশনের শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন প্ল্যাটফর্ম ‘আলোকিত টিচার্স’ বদ্ধপরিকর। আলোকিত টিচার্স ওয়েবসাইটে গিয়ে শিক্ষকগণ সমস্যা ভিত্তিক শিখন, খেলা ভিত্তিক শিখন, ক্লাস ম্যানেজমেন্টসহ অনেক কোর্স সম্পন্ন করে সময়োপযোগী শিক্ষার এই সংকটে নেতৃত্ব দিতে পারেন।
লেখক: এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অফিসার, আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন