সামান্য এক ভাইরাস আমাদের পৃথিবীর গতি হঠাৎ এভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে, তা ছিল কল্পনার বাইরে। পৃথিবীতে দেখা দেওয়া মহামারি ‘করোনা’ শুধু স্বাস্থ্য নিয়েই ভাবাচ্ছে না, ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের পুরো জীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে। পরিবর্তন করে দিয়েছে জীবনযাত্রার পথ। পৃথিবীর আগামী কর্মপরিকল্পনায়- ধ্যান-ধারণা বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং যোগাযোগের ধরন।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানুষের সম্পর্কগুলো অফলাইন থেকে অনলাইন হতে বাধ্য হচ্ছে। সেই সাথে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে যখনই কোনো মহামারি তৈরি হয়েছে, তখন নতুন চ্যালেঞ্জসহ নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ঠিক তেমনি করোনাভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে, কীভাবে সচল পৃথিবীতে হঠাৎ আসা মহামারির স্থবিরতা প্রযুক্তির দ্বারা সচল রাখতে হয়, কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই বৈশ্বিক মহামারির ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়।
সেই পুরনো ধ্যান-ধারণার শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয় এখন আর নেই। এখন ঘরে বসে মোবাইলে বা কম্পিউটারেই হয়ে যাচ্ছে একটা ক্লাসরুম, এক সাথে অনেকগুলো ক্লাসরুম নিয়ে তৈরি করা যায় অনলাইন বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরাও যে ক্লাস ভালো লাগে, সেই ক্লাসেও প্রবেশ করতে পারে খুব সহজে।
একটি মোবাইল বা কম্পিউটারের সাথে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে অনেক এডুকেশনাল ওয়েবসাইড ব্যবহার করেই আপনি তৈরি করতে পারেন অনলাইন বিদ্যালয়। জুম তেমনই একটি চমৎকার ওয়েবসাইড। জুম ওয়েবসাইড বিনামূল্যে ব্যবহার করে একজন শিক্ষক একসঙ্গে ১০০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস নিতে পারেন। উত্তর আমেরিকায় জুমের মাধ্যমেই চলছে ক্লাস।
এখন আসি আমাদের দেশের কথায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি আমরা ডিজিটাল এডুকেশন গড়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের সময় এখনই। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সমন্বয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা সম্পূর্ণ ডিজিটাল করতে পারলেই করোনা মহামারি থেকে দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
তাহলে কীভাবে এই ডিজিটাল এডুকেশন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি, তার কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
টিচিং-লার্নিং এনভায়রনমেন্ট
ডিজিটাল এডুকেশন ব্যবস্থা চালু করার জন্য সর্বপ্রথম আসে শিক্ষার পরিবেশ বা টিচিং-লার্নিং এনভায়রনমেন্ট প্রস্তুত করা। এই মুহূর্তে সবাই বাড়িতে নিজ নিজ আবাসস্থলে অবস্থান করছেন। নিজের চারপাশে যা আছে, সেখানে বসে এই টিচিং-লার্নিং পরিবেশ গঠন করতে পারেন। একজন শিক্ষক একটি কক্ষে কিংবা খাবারের টেবিলে বসেও চালাতে পারেন এই কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা নিজেদের পড়ার কক্ষে বা খাবার টেবিলে বসে অনলাইন এডুকেশন প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারেন। অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে পারেন, যেন বাসায় বসে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে এই পড়াশোনা করতে পারেন। অভিভাবক চেষ্টা করবেন বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ ঠিক আছে কিনা, বা মোবাইলে ডাটা আছে কিনা, তা খেয়াল রাখতে। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক মনোবলকেও সুদৃঢ় করাটা লার্নিং এনভায়রনমেন্টের অংশ।
টিচিং টুলস
লার্নিং এনভায়রনমেন্ট নিশ্চিত হলে এখন আসি টিচিং টুলস নিয়ে। মোবাইল, কম্পিউটার থাকলেই শিক্ষার্থীদের আর বেশি তেমন কিছুর প্রয়োজন হবে না। কারণ আপনি অনলাইনেই অসংখ্য টিচিং টুলস পাবেন। অনলাইনে হোয়াইট বোর্ডও পাওয়া যায়, যা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের আপনি সরাসরি লিখেও দিতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইগুলো এনসিটিবির ওয়েবসাইডে পাওয়া যায়। শুধু পাঠ্যক্রমই নয় বরং কারিকুলাম, শিক্ষক সহায়ক ও শিক্ষক সংস্করণগুলো পাওয়া যাবে এই www.nctb.gov.org ওয়েবসাইডটিতে।
তাছাড়া আপনি আরো যুগোপযোগী ও বিভিন্ন চমৎকার টিচিং টুলস আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন, টেনমিনিট স্কুল, ব্র্যাক এডুকেশন প্রোগ্রাম এবং সরকারে এটুআই প্রোগ্রামে। টিচিং টুলস নিয়ে নানা ওয়ার্কশপের আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানগুলো। আপনি প্রতিনিয়ত ফেসবুকে একটু খোঁজ রাখলেই এডুকেশনাল অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন।
অনলাইন ক্লাসরুম
টিচিং-লার্নিং এনভায়রনমেন্ট ও টিচিং টুলস তৈরি হলে এবার আমরা তৈরি করবো অনলাইন ক্লাসরুম। বর্তমানে টিচিং-লার্নিং প্রক্রিয়াটি একটি যৌথ কার্যক্রম। কারণ শুধু শিক্ষক পড়াবেন আর শিক্ষার্থীরা শুনবে এমন দিন আর নেই। শিক্ষকরা এখন চাইলেই যেকোনো তথ্য শেয়ার করা, আদান-প্রদান করা এবং শিক্ষার্থীদের মতামত সরাসরি জানতে পারেন।
শিক্ষকরা অনলাইনে যেসব ওয়েবসাইড ব্যবহার করতে পারেন, জুম (www.zoom.us), ইউটিউব লাইভ, ফেসবুক লাইভ, গুগল ক্লাসরুম (classroom.google.com) এবং মাইক্রোসফট টিম।
এই ওয়েবসাইডগুলোর সাহায্যে আপনি নিজের মতো করে তৈরি করতে পারবেন আপনার ক্লাশরুম। খুব সহজে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতাও দিচ্ছে ওয়েবসাইডগুলো।
পরীক্ষা ও মূল্যায়ন:
শিক্ষার্থীদের কীভাবে অনলাইন পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করবেন। অনলাইনে আপনি চাইলে সরাসরি প্রশ্ন করেও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারেন। গুগল ডক, গুগল ফর্ম ও আপনার ইমেইলের গুগল ড্রাইভে শিক্ষার্থীদের বলুন প্রশ্নের উত্তরগুলো আপলোড করতে। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা ছবি তুলে আপনাকে পাঠাতে পারেন ইমো কিংবা ম্যাসেঞ্জারে। মূল্যায়নের পাশাপাশি আপনি শিক্ষার্থীদের একই পদ্ধতি ব্যবহার করে ভিডিও কলে ওয়ান-টু- ওয়ান বা গ্রুপে দিতে পারেন ফিডব্যাক।
গ্রুপ ওয়ার্কের সুযোগ
আমরা সাধারণত বিদ্যালয়ে Professional Learning Community (PLC) করতাম। আবার শিক্ষার্থীদের দলীয় কাজের বিষয়ে উৎসাহিত করতাম। আপনি হয়তো ভাবছেন তাহলে অনলাইনে কি এই কাজগুলো করা যাবে না? অবশ্যই করা যাবে। শিক্ষার্থীদের আপনি গ্রুপ তৈরি করে দিতে পারেন বা শিক্ষার্থীরা চাইলেই নিজেরা নিজেরা গ্রুপে কাজ করতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় ফেসবুক মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমোতে গ্রুপ তৈরি করলে। শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যেও এই গ্রুপের মাধ্যমে নানা সমস্যা সমাধান করতে পারেন।
প্রশিক্ষণ
এই মুহূর্তে যে বিষয়টি অনেক প্রয়োজন, সেটা হলো বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলানোর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। শিক্ষকেরা চাইলেই বিনামূল্যে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। এখন অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ইমার্জেন্সি-টিচিং-লার্নিংয়ের উপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, পাশাপাশি সার্টিফিকেট ও দিচ্ছেন। অনলাইন প্রশিক্ষণ এখন আর শুধু শিক্ষকদের জন্য সীমাবদ্ধ নয় বরং অভিভাবকেরাও নিতে পারেন প্রশিক্ষণ। আমাদের দেশে এই মূহির্তে যে সব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন, তাদের মধ্যে আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশনের আলোকিত টিচার্স প্ল্যাটফর্ম (www.alokitoteacher.com), টেনমিনিটস স্কুল, লাইট অব হোপ, খান একাডেমি।
অফলাইনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দেখতে পারেন সংসদ টেলিভিশন। অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকেরা প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ক্লাস নেন এই টেলিভিশনের মাধ্যমে। অফলাইন ও অনলাইন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শিক্ষকেরা হয়ে উঠতে পারেন ‘ডিজিটাল এডুকেশনের’ অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লেখক: সহযোগী শিক্ষা গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।